“কোনো এক কালবৈশাখীর সন্ধ্যায়”
— আজ এত জলদি? ছাতার অভাবে বোধহয়!
— তাড়াতাড়ি এসেছি, কোনো সমস্যা?
— সমস্যার তো আদিঅন্ত নেই, সেসব কথা নাইবা বললাম।
— বলতে চাইলে বলতে পারো, আটকাবার কেউ নেই।
— গামছা দেব?
— নাহ, সামান্য জল লেগেছে।
— সামান্য জল থেকে শরীর খারাপ হলে সেবা কে করবে?
— সেবা নেবার জন্য ভিজে এসেছি বলছো?
— আজকাল অতিরিক্ত বুঝে যাও সব।
— মুখে চাবি দিয়ে রাখো তাই অগত্যা...
— চা খাবে?
— হ্যাঁ, তবে একা একা পোষাবে না।
— আমি তো চা খাওয়া ছাড়িনি।
— ওটা রেখে দিয়েছো নিজের সাথে এটা দেখে ভালো লাগে।
— ছাড়ব ভাবছি, চেষ্টা চালাচ্ছি।
— বেশ, শেষটুকুই বা বয়ে বেড়ানোর কি দরকার।
— খোঁচা না দিয়ে কিছু বলতে পারো না?
— নাহ, অশিক্ষিত মানুষ হলে যা হয়।
— শেখার ইচ্ছেটুকুও দেখিনি কখনো।
— আর দেখে লাভ কি? দিন তো ফুরিয়েই এল।
— ওহ, উকিলের সাথে কথা বলে এলে?
— হ্যাঁ। আর দিন কয়েক তারপর স্বাধীনতা পাবে।
— আমি কোনোকালে পরাধীন ছিলাম না।
— শোষনে ছিলে না?
— নাহ।
— ওহ, তবে?
— থাক না, চা ঠান্ডা হচ্ছে।
— শরীরও ঠান্ডা হবে একদিন, তার আগে জেনে যাই।
— জানার আদৌ সময় আছে তোমার?
— সময়টাই তো দিয়ে উঠতে পারিনি, আজ আছে!
— ওহ, এতদিন হয়নি তাহলে?
— জানি না।
— শেষ কবে এরম সন্ধ্যায় ঘরে এসেছ?
— মনে পড়ে না।
— ইচ্ছে হয়নি না? একবারের জন্যও...
— জানি না।
— চা খাওয়া হলে বেসিনে নামিয়ে দিও।
— চলে যাচ্ছো?
— যাবার জন্যই তো এতকিছু।
— হুম।
এরপর চায়ের কাপ ধরে একভাবেই বসে থাকে সুজিত। সীমন্তনির সাথে হয়তো এবারই শেষ চা খাওয়া একসাথে। এরপর আর কখনো ওরা একসাথে বসে চা খাবে না। সুজিত একঘন্টা বাদে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে একধারে হেলান দিয়ে বসে। বাড়িতে একটাই বিছানা। তবে বিছানার দুই মানুষের মাঝে যথেষ্ট ব্যবধান। বাইরে হাওয়ার বেগ টা কমে বৃষ্টি নেমেছে ঝড়ঝড়িয়ে। রুমের জানালার কাঁচে বৃষ্টির জলের ঝাপটা এসে লাগছে। সুজিত বই পড়ছে। কিন্তু বইয়ের পাতার মাঝে থাকা কোনো লাইনই তার মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। একদৃষ্টে ঐ পাতার লেখাগুলোর মাঝে চেয়ে রয়েছে আর ভাবছে সীমন্তনির চলে যাবার দিনের কথা। ঐদিন কিভাবে বিদায় জানাবে তাকে সুজিত? আদৌ বিদায় জানাতে পারবে তো?... আচ্ছা, সীমন্তনি সত্যিই চলে যাবে ওকে ছেড়ে! সীমন্তনি পারবে? ওর কষ্ট হবে না?
না না, ওর কেন কষ্ট হবে? সীমন্তনি স্বাধীনভাবে ভালোভাবে বাঁচতে পারবে এরপর। ওর কষ্ট পাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। কিছুক্ষন বাদে বাদে বজ্রধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। এভাবে খানিকক্ষণ চলার পর লাইট চলে যায়। সুজিত আর সীমন্তনি এক বিছানায়। সমস্ত ঘর অন্ধকারে ভরে গেছে। চোখ পাতলে কালো ছাড়া আর কিছু বোঝা দায়, সুজিত চুপ করে ঐভাবেই বসে বসে ভাবছিল কথাগুলো। আর মাঝে মাঝে বাইরে বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঘরটা একটু করে আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছিল। সুজিতের হঠাৎ খেয়াল হয় যে সীমন্তনি বাজের শব্দে প্রচন্ড ভয় পেত, আজ এতগুলো বাজেরশব্দ শোনার পর ও কীভাবে চুপ করে শুয়ে আছে? ও কি ঘুমিয়ে পরেছে?
সুজিত ধীরভাবে সীমন্তনির দিকে ঘাড় ঘোরায়, বিদ্যুতের আলোয় দেখে সীমন্তনির শরীরটা জোরে জোরে ওঠানামা করছে আর বাজ পড়ার পরমুহুর্তে কেঁপে উঠছে। সেই সাথে একটা ক্ষীন চাপা শ্বাসের ফসফসানি শোনা যাচ্ছে। সুজিত বুঝতে পারে না, ঠিক কতখানি কোনঠাসা হলে মানুষ তার ভয় কে এতটা চেপে রেখে নিজের ভেতরে ধামাচাপা দিতে প্রানপনে চেষ্টা করে; সুজিত এসব ভাবছিল আচমকা আরেকটা বাজ পড়ে, এটা একটু বেশিই জোরে ছিল ফলে সীমন্তনি অস্বাভাবিক রকম কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নেয়। সুজিত ধীরে ধীরে তার ডানহাত টা দিয়ে ওপাশ ফিরে থাকা সীমন্তনির কম্পমান কাঁধে রাখে। সীমন্তনি দীর্ঘ পাঁচ বছরের শুস্ক ঝড়ঝড়ে দাম্পত্যের পর এই আজকে তার বহু পুরোনো আর পরিচিত সেই হাতের স্পর্শ পেল। এই স্পর্শ একটা সময়তে সীমন্তনির সমস্ত শরীরকে তড়িৎবেগে স্থির করে দিতে পারতো। একটা সময় এই হাতের স্পর্শ সীমন্তনির সমগ্ৰ দেহে এক অনাবিল আনন্দ আর তৃপ্তির অনুভূতিতে ভরিয়ে দিতে পারতো। আজ বহুদিন বাদে এই চেনা হাতের ছোঁয়া পেয়ে সীমন্তনি হাতটাকে আঁকড়ে ধরে কোনোকিছু না ভেবেই, সুজিত এরপর ডানহাত দিয়ে আলতো চাপ দেয় সীমন্তনির কাঁধে। সীমন্তনির চোখ বেয়ে এরইমধ্যে জলের ধারা নামতে শুরু করেছে। এরপর সে ফুঁপিয়ে ওঠে। সুজিত তার ডানহাতের চাপ দিয়ে সীমন্তনি কে এপাশে ফেরায়, ফিরিয়ে দেখে বিদ্যুতের আলোয় সীমন্তনি চোখ বুজে রয়েছে যতটা সম্ভব আর ফোঁপাচ্ছে। তার চোখের পাশ বেয়ে সমানে জল গড়িয়ে যাচ্ছে দুপাশে। সুজিত এবার সীমন্তনির চোখদুটো হাত দিয়ে মুছিয়ে দিতে যায় কিন্তু চোখ স্পর্শ করার আগেই সীমন্তনি আরেকটা হাতদিয়ে সুজিতের হাত চেপে ধরে। সুজিত বুঝতে পারে, এই একটা শেষ সুযোগ দিচ্ছে সীমন্তনি। নিজেকে সুজিতের কাছে ছেড়ে দিতে চাইছে সীমন্তনি। সুজিত একটু ঝুঁকে সীমন্তনির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। এতে সীমন্তনির চোখ বেয়ে জলের ধারা নামতে থাকে আরো দ্রুত। সুজিত দুহাতে ধরে সীমন্তনি কে উঠিয়ে বসায় বিছানাতে। চোখ মুছিয়ে মুখটা ওপরে তুলে ধরে সুজিত। আরেকবার চুমু খায় সীমন্তনির কপালে,
— ভয় পাও এখনো?
— হ্যাঁ। (কান্না জড়ানো গলায় ফুঁপিয়ে বলে সীমন্তনি)
— আমাকে বলোনি কেন?
— কেন বলব?
— বলবে না?
— না।
— কি করা উচিত তাইলে আমার?
— জানি না।
— আমি তোমাকে স্পর্শ করলাম, প্রতিবাদ করবে না?
— না।
— কেন?
— জানি না।
— এই, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো জানো না।
— আমি আর পারছি না, আমি হাঁপিয়ে গেছি। তুমি জানো না কিচ্ছু।
— আচ্ছা, আমাকে জানাবে আজকে?
— এখন কেন জানাবো? কে তুমি?
— আমি কে? তা তো জানা নেই।
— তাহলে বলব কেন?
— না বললে আমি যে শেষ হয়ে যাব।
— কেন?
— তুমি চলে যাবে যে, তাই...
— আমাকে অবহেলা করার সময় মনে ছিল না?
— ভুল করেছি।
— আমি সময় চাইলে টাকার পেছনে ছুটতে, তখন ভাবোনি এসব?
— নাহ। এখন বুঝতে পারছি।
— কি বুঝছো?
— অন্যায় হয়ে গেছে।
— হ্যাঁ, আর তোমাকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।
— আমি তো পাচ্ছিই এখনও। আরো দিতে চাও?
— হ্যাঁ। (এই সময় আরেকবার বাজ পড়ল)
— এভাবে দেবে? (সীমন্তনি সুজিত কে জাপটে ধরেছে বাজ পড়ার ভয়ে)
— (নিশ্চুপ)
— কি হল? বলো?
— না। আমি জানি না কিছু...
— ছেড়ে দেব?
— না। কেন? খুব সমস্যা হচ্ছে?
— নাহ তেমন কিছু না, ভালোবাসবো?
— বিয়ে করোনি নাকি এর আগে?
— আমাকে শেষবার সুযোগ দেবে?
— হুম...
সুজিত সীমন্তনি কে আরো জড়িয়ে ধরে। সীমন্তনির মুখ তুলে কপালে গালে চুমু খেতে থাকে। সীমন্তনি এতদিন পর নিজের জমে থাকা প্রাপ্যগুলো পেয়ে আনন্দে কেঁদে ওঠে আবার। সুজিত দুহাতে সীমন্তনির মুখ ধরে তার ঠোঁটজোড়া নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। সীমন্তনি সুজিতে স্পর্শে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, সুজিতের সাথে সাড়া দিয়ে ওঠে। বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বেড়ে চলেছে রাত বাড়ার সাথে সাথে। অন্ধকারে কিছুটা থাকার পর চোখ অভ্যস্ত হয়ে যায় এর সাথে, এই অন্ধকারেই সুজিত সীমন্তনির সর্বাঙ্গ স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। সুজিত সীমন্তনির কাছাকাছি আসার পর বুঝতে পারে, ঠিক কতটা সময় পেরিয়ে গেছে সুজিত তার প্রিয় ভাঁজ গুলো কে মনযোগ দিয়ে দেখেনি সীমন্তনির শরীরে। এতটা সময় পেরিয়েছে যে সীমন্তনির দেহের যে পরিবর্তন ঘটেছে তা সে লক্ষ্যই করে উঠতে পারেনি। সুজিত ধীরে ধীরে দুহাতে সীমন্তনির পিঠ কোমড় আঁকড়ে ধরে, বলিষ্ঠ হাতের দৃঢ়তার সাথে সীমন্তনির শাড়ির আঁচল সরিয়ে ব্লাউজের বোতাম কটি টেনে খুলে ফেলে। সীমন্তনি তখনও জলভরা চোখে সুজিতের দিকে চেয়ে রয়েছে, সীমন্তনি চেয়ে দেখছে এই সুজিত কে যাকে সে দেখছিল বিয়ের মাস দুয়েক পর। দাম্পত্য এগোবার সাথে সাথে দেড়বছরের মাথায় এই সুজিত কেমন যেন উধাও হয়ে গেছিল সীমন্তনির কাছ থেকে। আজ এতগুলো দিন পেরিয়ে আবারও সুজিতের মাঝে তার পুনোরো সত্বা আর প্রেমাকাঙ্খী কে খুঁজে পেয়ে সীমন্তনি নিজেকে সঁপে দেয় তার কাছে। সুজিত সীমন্তনির ব্লাউজ ফেলে দিয়ে গলার দুপাশে ঠোঁট দিয়ে উষ্ণ স্পর্শ করে, সীমন্তনির ঘাড় গলা বেয়ে বুকে মধ্যস্থলে দীর্ঘ একটা চুম্বন দেয়। সীমন্তনি উত্তেজনার ফলে সুজিতের গেঞ্জির ওপর দিয়ে পিঠ আর চুল খাঁমচে ধরে। এরপর ক্রমশ রাতের গভীরতায় সীমন্তনি নিজেকে মিলিয়ে দেয় সুজিতের মাঝে। তারা একেওপরের মাঝে বিছানার যে ব্যবধান গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে ফেলে একসাথে। সুজিত ও সীমন্তনি মিলনে লিপ্ত হয় কালবৈশাখীর রাতের গভীরতায়...
— দাস
ছবি সংগৃহিত